সৃজনশীল লেখা(গল্প) রীনা পারভীন ।।

অনামিকার জ্যোতি
রীনা পারভীন

অনামিকা একটি মেয়ে। জন্মের পর থেকেই যুদ্ধ করে আসছে। জন্মের পরপরই মা মারা গেল। বাবা তখন থেকেই মেয়েকে বিরূপ চোখে দেখতে থাকে। মুসলমান ঘরে জন্ম নিলে সাতদিন পরে মিলাদ পড়ে নাম রাখা হয়। এই মেয়েটির বেলায় তেমন কিছু হলোনা। নানা- নানী ,দাদা – দাদী, না থাকার জন্য অনেক পরে এলো একমাত্র মামা ভাগনীকে দেখতে। দুলাভাইকে জিজ্ঞাসা করল ওর নামা কী?
কী আর রাগব রাক্ষসি। মেয়ে জন্মের পরপরই মাকে খেয়েছে । নাম রাক্ষসি । মামা একটু হেসে দিযে বল্লো, তাই কী হয় দুলাভাই! ও নাম অনামিকা। একমাস পর হলেও একটি নাম ওর কপালে জুটলো।
বিধাতা যদি সাথে থাকে নামছাড়া মানুষের নাম ছড়ায় অালোর গতীতে। অনামিকা পাঁচ বছর পর্যন্ত বড় হলো মামীর কাছে। মামার অঢেল সম্পত্তি থাকা সত্বেও মামীর কাছে অনামিকার খাওয়া পরা বেশি হয়ে গেল। মামা অনামিকার দেখা শুনার জন্য একজন আয়া রাখল। মামী কিছুদিন পরেই আয়ার টাকা কাটা শুরু করলো।
এক পর্যায়ে মামা বিরক্ত হয়ে সৎমায়ের নিকট রেখে আসে।এবার শুরু হলো অনামিকা কঠিন জীবন।
ইতিমধ্যে অনামিকার একটি সৎভাই জন্ম নিয়েছে। অনামিকার বাবা জুন্নু মিয়া ঢাকা শহরে ফুটপাথে বসে ফল বিক্রি করে। দুই, তিন মাস পরে বাড়িতে আসে। সারাদিন ফল বিক্রি করে শেষের নষ্ট পঁচা ফলগুলি নিয়ে বেতাঘ গ্রামে আসে। প্রতিবারই জুন্নু মিয়া বাড়িতে এসে পৌঁছায় ফজরের আযানের পরে। অনামিকা খুশি হয়ে হেমন্তের ঝরা শিউলি কুড়িয়ে মুঠামুঠা বাবাকে দেয়। বাবা প্রাণখোলো হাসি দিয়ে দুই হাতে ফুলগুলি গ্রহণ করে। কিন্তু বিধি বাম। এই দৃশ্য দেখে ফেলে তার সৎমা।অনামিকা কিছু নাভেবেই দ্রুত মায়ের হাতে ফুল তুলে দিতে যায়। কিন্তু মা একঝটিকা দিয়ে ফুলগুলি ফেলে দ্যায়। নির্বিকার হয়ে সেই দৃশ্য একজন অবলোকন করলো। একটি ফুলসহ অনেকগুলি ফুল আজ অবমাননা হলো।
বাবার কাছে অনামিকা ব্যক্ত করলো। মিনি, রানু ওরা স্কুলে যায় অামি যাব। এ কথা শুনার সাথে সাথে সৎমা বলে ওঠে নবাবের ঘরের মেয়ে স্কুলে ভর্তি হবে। মেয়ে ও বাবা একথা শুনে চুপ করে থাকে। অনামিকার চাচি মিনির মা সাথে সাথে জবাব দেয়, নবাব নাহােক, ঝারুদার হােক, তবু স্কুলে ভর্তি হবে। জুন্নু তুমি ওকে আজই ভর্তি করে দিয়ে আস। তারপরে আমি দেখব। জুন্নু মিয়া মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে ঢাকায় চলে যায়। অনামিকা মিনির সাথে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। সৎমায়ের অত্যাচারের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সংসারের সবকাজ শেষ করে খেয়ে নাখেয়ে তারপর অনামিকা স্কুলে যায়। কিছুদিন এমন চলার পরে একদিন সৎমা অনামিকার বইগুলি পুড়িয়ে ফেলে। প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী অনামিকা দিশাহারা হয়ে পা ছড়িয়ে কাঁদছিল । চাচি এসে বলে, আমি স্কুলে যেয়ে তােকে আবার বই এনে দিব।
সরকার স্কুলে জানুয়ারি ,ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বই বিতরণের কাজ শেষ করে। অনামিকা যখন শুনলো এখন মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ চলে তখন আর জোড়ে জোড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ঐটুকু বয়সে অনামিকা বুঝে গেল বই জীবনের সবশ্রেষ্ঠ বিষয়। যা সুখের সময় জড়িয়ে থাকে হৃদয়ে। দুখের সময় চোখের পাতায় ঝিলমিলিয়ে পড়ে। কারন অনামিকা আগেই জেনেছে এই বই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়না।
পরের দিন অনামিকা চাচির সাথে স্কুলে যায় মিনিকে নিয়ে। চাচি হেডমিস্টেসকে বলে পাশাপাশি বসে লেখা পড়ার ব্যবস্থা করলেন। এভাবে রাতে দুইজনে এক মাদুরে বসে লেখা পড়া করে। পড়ার মাঝে অনামিকার সৎমা কাজের ফরমায়েশ দেয়। দৌঁড় দিয়ে অনামিকা কাজ সেরে এসে আবার পড়া- লেখায় মন দেয়।
এইভাবে চলতে থাকে কাজ আর পড়া-লেখা । সৎমায়ের অত্যাচারের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অনামিকার রেজাল্ট সবার থেকে ভালো হলো। এই উৎসাহ পেয়ে অনামিকা মিনি যখন খেলতে যায়, বিকেলবেলা মনোযোগী হয়ে লেখা পড়া শুরুকরে। অথচ লেখা – পড়াতেই আছে প্রতিটা শিক্ষার্থীর জন্য খেলা- ধুলা করা আবশ্যক। যার বয়স ছুটাছুটি করে বেড়ানো সেই বয়সে সে কৃপণের মতো সময়ের ব্যবহার বুঝে গিয়েছে।
বার্ষিক পরীক্ষায় অনামিকা প্রথম স্থান অধিকার করলো।মিনির রোল অনেক নিচেরদিকে চলে গেল।সে জন্য অনামিকা কেঁদে চাচিকে বলে, চাচি মিনির বই আমি নিয়ে পড়াতে মিনির রেজাল্ট এমন হয়েছে। চাচি হেসে বলে, নারে পাগল মিনির মেধা আর তোর মেধা আকাশ – পাতাল পার্থক্যআল্লাহ্ তোকে অনেক মেধাবী করে পাঠিয়েছেন । কিন্তু আমরা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারছিনা আমাদের স্বল্প পরিসরের ব্যবস্থাপনায়। এইভাবে অনামিকা পিএসসি, জেএসসি, এসএসসিতে বৃত্তি পেয়ে লেখা-পড়া চালিয়ে যায় এবং সফলভাবে আই এ পাশ করে বাংলা সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়।অনাস ফাস্টক্লাস নিয়ে পাশ করার পরে একটি বিষয় আবার বড় হয়ে দেখা দিল। হ্যাঁ যে বিষয়টি মানুষের হাতে নাথাকলে মানুষ বুদ্ধিহারা হয়ে যায় ক্রমেই।
এতোদিন অনামিকা একটি বাসাতে চার ভাই -বোনকে প্রায়ভেট পড়িয়ে প্রায় বিশ হাজার টাকা ইনকাম করতো । হল থেকে ধানমন্ডি ১৫ নাম্বার রোডে দিনে তিনবার যেত। অনামিকার শিক্ষথীদের নাম ছিল যুথি, বিথী, তরুণ ও বরুণ । তরুণ একাদশ শ্রেণি , যুথি নবম শ্রেণি , বিথী সপ্তম শ্রেণি, বরুণ চতুর্থ শ্রেণি । প্রায়ই অনামিকার হোস্টলে মিল বন্ধ করতে হতো । শিক্ষার্থীদের পিড়াপীড়িতে খেয়ে আসতে হতো। এইভাবে সুখের দিনগুলি কেটে গেল খুব দ্রুত।
একদিন পড়াতে এসে দেখে শিক্ষার্থীদের মন খারাপ । জিজ্ঞাসা করাতে বলে, বাবার বদলির অডার হয়ে গিয়েছে । তাতে কি হয়েছে নতুন যায়গা যাবা দেখবা অনেক ভালো লাগবে।অনামিকা মুখদিয়ে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে অনেক দূরে। অভাগার দুঃখ আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকে হৃদয় ক্ষরণ করে।
এক সপ্তাহের মধ্যে যুথিরা বাসা শিপ্ট করে চলে গেল। যাওয়ার সময় যুথি, বিথী আমাকে ধরে অনেক কাঁন্না করতে থাকলো। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম । খালাম্মা যখন এসে বল্লো অনামিকা তুমি কথা বলছনা কেন? এবার বুক ফেঁটে কাঁন্না আসলো আর বিলাপ করে বলতে থাকলাম জন্মের সময় মাকে হারিয়েছি। ঢাকায় এসে আমি আপনার কাছে মায়ের আদর পেয়েছি। খালাম্মা আজ থেকে আমি আবার মা ছাড়া হয়ে যাচ্ছি । যুথির মা অনেক্ষণ অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে রাখে। ট্রাকের হন বাজতে থাকে কানের তালা ফাটিয়ে তবু মায়ের বুক থেকে অনামিকা নড়ছেনা । এক পর্যায়ে অনামিকা মূর্ছা যায়। এদিক দিয়ে সময় চলে যাচ্ছে। এবার যুথির বাবা বলে, শোন, অনামিকাকে আমাদের সাথে নিয়ে চল। মাইক্রোগাড়িতে অনামিকাকে শুইয়ে দিল যুথির বাবা। নিষ্পাপ শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে মেয়েটি যেন তার মা- বাবা তাকে নিয়ে যাচ্ছে এক শহর থেকে অন্য শহরে। অনামিকা ঘুমের ভিতরে দু’ একবার মিনি, মিনি বলে ডাক দিয়ে আবার অবচেতনভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। এইভাবে কখন রংপুরে গিয়ে পৌঁছালো তা টের পেলনা । এবার গাড়ি থেকে নামার সময় অনামিকাকে ডেকে তোলা হলো।
ধানসিড়ি১৫/০৩/২২
চলবে

12125 commentsLikeCommentShare

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *