সৃজনশীল লেখা(গল্প) সারমিন খাতুন।।

অনন্য ফাতেমা
মোসাঃ সারমিন খাতুন

দুধে আলতা গায়ের রঙ ফাতেমার। ফুলের মতো টুলটুলে, ঠিক যেন ফুলপরী। দেখতে সুন্দর আর গুণবতী হলে কী হবে জন্মেছেতো গরীবের ঘরে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে ফাতেমা। হঠাৎ ভাল ঘরের বিয়ে আসে। বাবা মা তেমন কিছু না ভেবেই বিয়েতে মত দেন। ছেলে দেখতে কুৎসিত, তাতে কী হয়েছে! ছেলের বাড়ি আছে, আম বাগানসহ বেশকিছু জমি আছে। ছেলে মানুষ আবার কম কিসে! ফাতেমার অমতেই বিয়ে হলো।

নাবালিকা ফাতেমা, তাই শ্বশুরবাড়ি সঙ্গী হিসেবে তার নানীও গেছে । এলাকার লোকজন গোল করে ঘিরে বউ দেখছে। এরমাঝে কেউ কেউ বলছে ছোঁড়ার কপাল ভাল, আগের বউটাও সুন্দরী ছিল। বেলাশেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে ফাতেমা, নানী কোনোভাবে সামলিয়ে নেন। বাসর হয় ফাতেমার।

একে একে সবার দায়িত্ব শেষ। এবার একা লড়ার পালা ফাতেমার। তাই সবকিছু মানিয়ে নিতে নিজেকে ভেঙেচুরে প্রতিদিন নতুন করে সাজায় ফাতেমা। কিন্তু কপাল বলেতো কিছু আছে। নির্যাতন শুরু হয় ফাতেমার উপর। ফাতেমা যেটাই করে সেটাই ভুল। কারণ ভাবির সাথে তার স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক, ভাই আধাপাগল মানুষ। উদাহরণসরূপ- ফাতেমা একদিন ভাত তরকারি রান্না করে জমিতে তার স্বামী ও কামলার জন্য বেঁধে দেয়। কোন এক সুযোগে তার জা তরকারির বাটিতে ঘুটার বড় একটা গোটা ছাই ঢুকিয়ে দেই। কামলারা খেতে বসে এসব দেখে নিশ্চিত হয় যে এটা ফাতেমার কাজ নয়। কিন্তু তার স্বামী বাড়িতে এসে ফাতেমাকে বেধড়ক মার দেয় এবং সারারাত চৌকির পায়ার সাথে বেঁধে রাখে। সকালে অসহনীয় যন্ত্রনায় ফাতেমা তার বাবা মাকে ডেকে পাঠায় এবং সংসার করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। এরপর তাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।

দিন যায় কষ্ট শুকায়। নিয়ে যাবে তাই তার স্বামী শ্বশুরবাড়ি ঘুরফির করে। ফাতেমা যেতে নারাজ। একপর্যায়ে ফাতেমার মাও ফাতেমাকে তেড়েবেড়িয়ে আমের ডাল দিয়ে মারে, এলাকার লোকজনের কাছে ঝাড়ফুঁক করে। ফাতেমাকে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে হয়। ফাতেমার মা ও দাদী ভাবে ফাতেমার কোলে সন্তান এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু উপায়! ওরতো ঋতুচক্রই শুরু হয়নি অর্থাৎ শারীরিক পরিপক্বতাই আসেনি। তারা বিভিন্ন ডাক্তারি ও কবিরাজী ঔষধ খাওয়াতে থাকে তাকে। যেভাবেই হোক ফাতেমার পেটে সন্তান আসে। কিছুই খেতে পারে না ফাতেমা, শুধু নাকি আম ভর্তা খেয়ে থাকে কারণ ওটাতেই রুচি। সাত মাস যেতেই ব্লিডিং শুরু হয়। একপর্যায়ে অপরিপক্ব ছেলে সন্তান আসে তার দুনিয়ায়। মা ছেলে প্রাণে বেঁচে থাকে মরার মতো হয়ে।

দিন যায় নির্যাতন বাড়ে, ভালোবাসা বাড়ে না। তিন বছর বয়সী ছেলেকে রেখে পাওনার খাতায় শুন্যতা নিয়ে ডিভোর্স হয় ফাতেমার। ফাতেমা বাপের বাড়িতে ছেলের জন্য পাগলপ্রায়। কিন্তু নিরুপায়। নানা-নানী তাদের নাতিকে কম ভালোবাসে না কিন্তু রাগে ক্ষোভে নাতীকে নিতে রাজি হয়নি বরং ডিভোর্সের দিন ফাতেমার গলা জাপ্টে ধরে থাকা ছেলেকে ছিনিয়ে তার বাপের কোলে ফেলে দেয় তার নানা। ফাতেমা অজ্ঞান। ছেলের কান্নায় কাঁদছে সবাই। চেয়ারম্যান সাহেব সেদিন ফাতেমার স্বামীর উল্টাপাল্টা কথাবার্তায় (সে নাকি ভাবীর সাথে সম্পর্ক ছাড়তে পারবে না) কানের উপর একটা জোরেসোরে চড় মেরেছিলেন। লোকমুখে শোনা যায় সে নাকি এখনও এক কানে বধির।

কষ্টার্জিত কলিজার টুকরাটাকে ছাড়াই বাপের বাড়িতে দিন কাটে ফাতেমার। ছেলের জন্য প্রার্থনার সবরকম ইবাদাতে মনোযোগী হয় ফাতেমা। কাছেই ফাতেমার নানীর বাড়ি। মামী তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। যদিও একসময় মামীও তাকে রক্ষা করতে পারেনি। কারণ মামার অভাবের সংসার। মামা-মামী বহুকষ্টে মামাতো ৫ ভাইবোনকে বাইরে লিখাপড়া করাচ্ছে। তারা বিভিন্ন নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। গ্রামের লোকে টিজ করে এতো কষ্টে মেয়েদের পড়ায়ে কী লাভ। যাই হোক, মামী এবার সবকিছু ভেবে ফাতেমাকে স্কুলে ভর্তি করায়। ফাতেমা কিছুটা হলেও ছেলেকে ভুলে থাকে।

ফাতেমা এসএসসি তে ৪.৯৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। অনেকরকম খাবার দাবার নিয়ে ছেলেকে দেখতে যাই শ্বশুরবাড়ির পাশের বাড়ি। ছেলের দেখা না পেয়ে হতাশা নিয়ে ফিরে আসে ফাতেমা। এর আগে ফাতেমার ছোটোভাইও ভাগনেকে বেশ কয়েকবার দেখতে গেছে তবে দেখতে দেয়া হয়নি। একসময় ফাতেমা জানতে পারে তার ছেলে এখন ক্লাস থ্রী তে পড়ে। এবার সে স্কুলেই ছেলের সাথে দেখা করতে যাই তবে খালি হাতে কারণ এর আগে প্রস্তূতি নিয়ে গেলেও ছেলেকে কাছে পাইনি। স্কুলের শিক্ষক সবকিছু জেনে একটি ফাঁকা কক্ষে দরজা বন্ধ করে মা ছেলেকে দেখা করায়। আসার সময় ফাতেমা ছেলের স্যারের হাতে ১০০ টাকা দিয়ে আসে প্রতিদিন ছেলেকে যেনো ৫/১০ টাকা করে খেতে দেয়। একই স্কুলে ছেলের চাচাতো ভাই পড়তো, সবকিছু টের পেয়ে বাড়িতে বলে দেয় সে। অবশেষে ছেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। বদ্ধ জীবন কাটে সুমনের।

এদিকে ফাতেমার সাবেক স্বামীর আরেকটি বিয়ে হয়। সে সংসারেও নির্যাতন তথা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির কথা জনমুখে শোনা যায়। ঐ পরিবারে অনাদরে বড় হতে থাকে সুমন।

ইতোমধ্যে ফাতেমার মামা মারা গেছে। মামী আর মামাতো ভাইবোনদের দেখে আর তাদের দেয়া উৎসাহে সে পড়ালিখায় আরও মনোযোগী হয়। সে এইচএসসি তে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। অতঃপর সে সরকারি কলেজে একাউন্টিং এ অনার্স ভর্তির সুযোগ পায়। মামাতো ভাইবোনেরা তাকে কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেই যাতে সে নিজে নিজেই পড়ালিখা চালিয়ে নিতে পারে।

ঐদিকে সুমন রাজমিস্ত্রির কাজ করে। একসময় ফাতেমা খবর পায় -সুমন একটি হোটেলে কাজ করছে। ছুটে যায় ছেলেকে কাছে পেতে কারণ সে এখনও স্বপ্ন দেখে ছেলেকে ফিরে পেলে নিজের মনের মতো করে পড়াশোনা করাবে, বেশি বড় হয়ে গেলে আর নাগালে পাবে না তখন মানুষও করতে পারবে না। হোটেলের মালিক মা ছেলেকে আলাদা করে দেখা করার সুযোগ করে দেয় কিন্তু সুমন দুই হাত দিয়ে তার নিজের মুখমণ্ডল এমনভাবে চেপে ধরে থাকে যে ফাতেমা ছেলের মুখদর্শন করতে ব্যর্থ হয় । কারণ সুমনকে বোঝানো হতো- তার মা খারাপ, তাকে রেখে চলে গেছে। সুমনের জিদের কাছে হার মেনে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিসে আসে ফাতেমা। মামী এসব শুনে ফাতেমাকে বকা দেয়। কারণ ফাতেমারওতো ভবিষ্যৎ বলে কিছু একটা আছে। তাহলে কেন সে অতীতের পেছনে ছুটছে!

ফাতেমার পড়ালিখা চলতে থাকে। ক্লাসে ভাল সাড়া পেয়ে এবং পরীক্ষায় ভাল ফল করতে দেখে কলেজের অধ্যক্ষ ফাতেমার সবরকম খোঁজ নিয়ে তার পরীক্ষার ফীসহ বিভিন্ন খরচ নিজে বহন করতে রাজি হোন। অতঃপর অনার্সে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট পেয়ে উত্তীর্ণ হয় ফাতেমা।

চাকুরীর প্রস্তূতি নিতে থাকে ফাতেমা, এদিকে মাস্টার্সও চলমান। চাকুরীর পরীক্ষা দিতে গিয়ে পরীক্ষা কক্ষে দায়িত্বরত কর্মকর্তার চোখে পড়ে ফুলপরীটা। বিসিএস ক্যাডার ছেলের জন্য বউ হিসেবে ফাতেমাকে ভদ্রলোকের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ফাতেমার ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক পরিচয় না খুঁজে সরাসরি তার ডিপার্টমেন্টের স্যারদের জানান। স্যারেরা ফাতেমাকে বিয়ের ব্যাপারে খুব করে বলে। বাল্যকালে ফাতেমার একটা বিয়ে হয়েছিলো এটুকুই ডিপার্টমেন্টের স্যারেরা জানতো কিন্তু বাকিটুকু অযথা ফাতেমা কাউকে জানাতে চাচ্ছে না কারণ এখনও ফাতেমার বিয়ে করার মতো কোনোরকম মানসিকতা তৈরি হয়নি। শেষমেশ স্যারদের সে কোনোরকম বুঝাতে সমর্থ হয় যে সে আপতত বিয়ে করছে না।

ফাতেমা বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারে চাকুরীরত কিন্তু এখন পর্যন্ত আর কোনো পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে সে সাহস পায় না। ছেলের পরিচয়ও কাউকে দিতে পারে না, নিজেও মেনে নিতে পারে না কারণ সুমন সুপথে নেই, তবে মায়ের সাথে ফেসবুক ফ্রেন্ড হিসেবে আছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *